Table of Contents
কাচ কী?
কাচ নির্মাণ উপকরণের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। বালিকে উচ্চতাপে বিগলিত করে কাচ তৈরি করা হয়। কাচ স্বচ্ছ, অদানাদার, ভঙ্গুর এবং আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ গুণসম্পন্ন কঠিন পদার্থ।
কাচ তৈরির উপাদান
কাচ তৈরির জন্য বিভিন্ন উপাদান লক্ষ করা যায়। সব ধরণের কাচের মূল উপাদান বালি (SiO2)। কাচের মূল উপাদান গুলো হলো: (ক)বালি-50% হতে 78% (খ)পটাশ-2% হতে 17% (গ)-চুন 6% হতে 15% (ঘ)সোডা-3% হতে 16% (ঙ)অ্যালুমিনা-1% হতে 7% ও (চ) অন্যান্য উপাদান (যেমন- বোরক্স, রঞ্জক, লেড অক্সাইড, ভাঙ্গা কাচ।
ঈপ্সিত কাচের জন্য উপরোক্ত উপাদানের কোন কোনটির দরকার নাও হতে পারে। সকল কাচের জন্যই মূল উপাদান সিলিকা বা বালি। এ বালি গলাতে খুবই উচ্চতাপের দরকার হয় বিধায় এগুলোর সাথে ক্ষারকীয় সামগ্রী (যেমন- সোডিয়াম কার্বনেট বা পটাশিয়াম বা সোডা) দিয়ে গলনাষ্কের পরিমাণ হ্রাস করা হয়। এতে সান্দ্রতা কার্যোপযোগী হয়।
লাইম কাচের ক্ষণভঙ্গুরতা হ্রাস করে, পটাশ কাচের তাপরোধীতার মাত্রা বৃদ্ধি করে এবং ম্যাগনেশিয়া কাচের অবাঞ্ছিত ময়লা পরিষ্কার করে ও কাচে স্বচ্ছতা আনয়ন করে। কাচের ভাঙা টুকরা কাজে লাগানোর জন্য সমশ্রেণির কাচ তৈরিতে এগুলো ব্যবহার করা হয়।
গলিত কাচের সাথে রঞ্জক যোগে রঙিন কাচ তৈরি করা হয়। সচরাচর ব্যবহৃত রঞ্জকগুলোর মধ্যে কোবাল্ট, নিকেল ও ম্যাঙ্গানিজ এর অক্সাইড, ক্রোমিক অক্সাইড, ক্রায়োলাইট ও টিন অক্সাইড অন্যতম। কাচে লাল বর্ণের জন্য গোল্ড সিলিনিয়াম সালফাইড, কপারাস অক্সাইড ইত্যাদি, সবুজ বর্ণের জন্য ক্রোমিক অক্সাইড, হলুদ বর্ণের জন্য ক্যাডমিয়াম সালফাইড।
ভায়োলেট বর্ণের জন্য ম্যাঙ্গানিজ ডাই-অক্সাইড, নীল বর্ণের জন্য কোবাল্ট অক্সাইড, কপারিক অক্সাইড আম্বর বর্ণের জন্য সালফার ও আয়রন অক্সাইড, কালো বর্ণের জন্য ফেরিক ও কপারিক, কোবাল্ট নিকেল, ম্যাঙ্গানিজ অক্সাইড রঞ্জক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
কাচের ধর্ম
১.এগুলো উচ্চতাপে প্রসার্য, অদানাদার ও ভঙ্গুর সামগ্রী।
২.বিভিন্ন প্রকার কাচের ওজনে তারতম্য ঘটে। তবে এগুলো পানির তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ ভারী।
৩.এগুলোর আলোকীয় ধর্ম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
৪.এগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় কম আক্রান্ত হয়।
৫.গ্লাস উল বা গ্লাস ফাইবার আকারে এগুলো তাপ ও শব্দ অন্তরক।
৬.গলিত গ্লাস বিদ্যুৎ পরিবাহী।
৭.এগুলো স্বাভাবিক তাপমাত্রায় উচ্চমানের বিদ্যুৎ প্রতিরোধী ও ডাই ইলেকট্রিক স্ট্রেংথ-সম্পন্ন।
৮.এগুলোকে স্যান্ড ব্লাস্টিং এর মাধ্যমে ঘোলা করা যায়।
৯.গলনাঙ্কে এগুলোর টুকরাকে জোড়া দেয়া হয়।
১০.এগুলোকে আলো অপসারী ও আংশিক স্বচ্ছ অবস্থায় তৈরি করা যায়।
বিভিন্ন ধরণের কাচের বৈশিষ্ট্য
১.সোডালাইম গ্লাস: বালি, চুনাপাথর এবং সোডা এগুলোকে প্রায় ১২০০ ডিগ্রী সে. তাপমাত্রায় গলিয়ে সোডালাইম গ্লাস তৈরি করা হয়। এটি সফট গ্লাস নামেও পরিচিত। এগুলো বেশ সস্তা এবং অপেক্ষাকৃত কম তাপে বিগলিত হয়।
এগুলো সাধারণত কন্টেনার,বাল্ব ও অন্যান্য সাধারণ সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। গ্লাস তৈরি প্রক্রিয়ায় ভিন্নতা এনে বিভিন্ন কাজের উপযোগী ও গড়ন ভিন্নতার কাচ তৈরি করে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা হয়ে থাকে।
২.পটাশ-লাইম গ্লাস: তাপে পটাশিয়াম কার্বনেট, বালি, লাইম স্টোন গলিয়ে এগুলো তৈরি করা হয়। এগুলো পানি ও রাসায়নিক ক্রিয়ায় আক্রান্ত হয় না। এগুলো গবেষণাগারের সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
৩.লেড গ্লাস: তাপে ফ্লিন্ট, লিথার্জ এবং পটাশিয়াম কার্বনেট গলিয়ে এগুলো তৈরি করা হয়। এগুলো ফ্লিন্ট গ্লাস নামেও পরিচিত। এগুলোর প্রতিফলন সূচক অধিক কিন্তু তাপ দেওয়া কালে ফারনেসের নির্গত গ্যাসের স্পর্শে এলে কিঞ্চিৎ কালো ও অস্বচ্ছ হয়। এগুলো লেন্স, প্রিজম, অপটিক্যাল যন্ত্রপাতি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
৪.বোরোসিলিকেট গ্লাস: এগুলো বিশেষ ধরনের গ্লাস। এগুলো তৈরিতে বালির কিয়দংশের পরিবর্তে বিভিন্ন অনুপাতে বোরন অক্সাইড, অ্যালুমিনিয়াম ও সোডিয়ামের অক্সাইড মেশানো হয়। এ গ্লাস তাপ, রাসায়নিক ক্রিয়া ও আঘাত প্রতিরোধী, তাপমাত্রার আকস্মিক পরিবর্তনে তেমন আক্রান্ত হয় না। এগুলো গবেষণাগারের যন্ত্রপাতি ও রান্নাবান্নার সামগ্রী তৈরিতে অধিক ব্যবহৃত হয়।
৫.পাইরোসিরাম: পাইরোসিয়াম অধুনা আবিষ্কৃত বিশেষ ধরণের গ্লাস। এগুলো কর্কের ন্যায় পানিতে ভাসে, ইস্পাতের মতো শক্তিশালী। এগুলো সাধারণ জয়েনারি টুলস দ্বারা চেরাই করা যায়, ড্রিল করা যায় এবং স্বচ্ছ। এগুলো গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরিতে বেশ উপযোগী।
৬.শিট গ্লাস: শিট গ্লাস তৈরির জন্য গ্লাসের গলিত উপাদানের মিশ্রণ সমতল টেবিলে ঢালাই করে অ্যানেলিং চেম্বারে নিয়ে আরো হিট ট্রিটমিন্ট করা হয়। এগুলো নিখুঁত সমতল ও সমপুরুত্বের হয় না। এগুলো দরজা-জানালা গ্লেজিং-এ ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
৭.প্লেট গ্লাস: প্লেট গ্লাস সমতল ও সমপুরুত্বের নিখুঁত গ্লাস এবং এগুলোতে দৃশ্যের ক্রটিবিচ্যুতি ঘটে না। এ জাতীয় গ্লাস তৈরিকালে গলিত গ্লাস উপকরণকে ঢালাই টেবিলে যথাযথভাবে সমতল ও সমপুরুত্বে ঢালাই করে প্রয়োজনীয় গ্রাইন্ডিং ও পলিশিং করে উভয় পৃষ্ঠ সতর্কতার সাথে সমতল করে দেয়া হয়। এগুলো কারটেন ওয়ালিং, জানালা ও পার্টিশনে বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
৮.অয়্যার্ড গ্লাস: অয়্যার্ড গ্লাস তৈরিতে ঢালাইকালে ঢালাই পুরুত্বের কেন্দ্রের মাঝে তারজালি দেয়া হয়, ফলে গ্লাস ভেঙে গেলেও কাচ খন্ডগুলো আটকে থাকে। এ জাতীয় গ্লাস অগ্নিরোধী। এগুলো স্কাইলাইট ও ছাদের ট্রাসে বেশ উপযোগী।
৯.সেফটি গ্লাস: সেফটি গ্লাস তৈরিতে দুটি প্লেট গ্লাস শিটের মাঝে স্বচ্ছ সেলুলয়েড বা রজনের শিট স্থাপন করে তাপ ও চাপে একটি শিটে রূপে তৈরি করা হয়। এগুলো যানবাহন, কার ইত্যাদির জানালায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
১০.ফাইবার গ্লাস: ফাইবার গ্লাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ গ্লাস। এগুলো শব্দ ও তাপ অন্তরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সোডা লাইম গ্লাস তৈরির গলিত উপাদানকে সরু জেটের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত করে ফাইবার বা কাচের আঁশ তৈরি করা হয়। এগুলো এয়ারক্রাফট, মিসাইল অন্তরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
১১.ফোম গ্লাস: ফোম গ্লাস তৈরিতে কার্বন ও অন্য কোন গ্লাসের পাউডারের সাথে মিশিয়ে তৈরি করা হয়। এতে গ্লাস সচ্ছিদ্র ও হালকা হয়। এগুলো সাধারণ ম্যাসনরি টুলসে কাটা যায় এবং সহজে কাজ করা যায়। এগুলো তাপ-শব্দ অন্তরক হিসেবে কক্ষের পার্টিশনে বিশেষ করে এয়ারকন্ডিশনড বিল্ডিং-এ ব্যবহৃত হয়।
১২.ফ্রোস্টেড গ্লাস: ফ্রোস্টেড গ্লাসকে গ্রাউন্ড গ্লাস বা অবস্কিউরড গ্লাস বলা হয়ে থাকে। এগুলোর এক পৃষ্ট ঘষে দেয়া হয় বা গলিত গ্লাস পাউডার দিয়ে দেয়া হয়। তাই এগুলো আংশিক স্বচ্ছ হয়ে থাকে। এগুলো জানালার প্যান, ভেন্টিলেটর আলো বিকীর্ণকরণের জন্য ব্যবহৃত হয়।
১৩.কালার্ড গ্লাস বা স্টেইনড গ্লাস: সাধারণ গ্লাস শীতল অবস্থায় শক্ত, ভঙ্গুর ও স্বচ্ছ হয়ে থাকে। কাচ তাপে কোমলায়ন করে গলে যাওয়ার পূর্বে ঈপ্সিত বর্ণের জন্য প্রয়োজনীয় ধাতব লবণ ও অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে রঙিন গ্লাস তৈরি করা হয়। এগুলোকে স্টেইনড গ্লাস ও বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সবুজ বর্ণের জন্য ক্রোমিয়াম, নীল বর্ণের জন্য কোবাল্ট এবং লাল বর্ণের জন্য ম্যাঙ্গানিজ অক্সাইড ব্যবহার করা যায়।
১৪.টেস্পারড গ্লাস: সাধারণত গ্লাস শীতল অবস্থায় শক্ত, ভঙ্গুর ও স্বচ্ছ হয়ে থাকে। এ গ্লাসকে তাপে কোমলায়ন করে টেস্পারড গ্লাস তৈরি করা হয়।
কাচের বিভিন্ন প্রকার ব্যবহার
আজকাল কাচের বহুল ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। অফিস-আদালতের দরজা-জানালায়, ঢালু ছাদের স্কাইলাইটে, সিঁড়ির সান লাইটে, দরজা-জানালার উপরের ফ্যান লাইটে, আলমারির দরজায়, ড্রেসিং টেবিলে, দোকানের প্রদর্শন কক্ষে, শোকেসে, অফিস-আদালতের টেবিল আচ্ছাদনে, বাথরুমে, গবেষণাগারে, যানবাহনের জানালায়, পানপাত্র, বাসন-কোসন, ছাইদানি, ফুলদানি, রাসায়নিক গবেষণাগারে সরঞ্জাম কাচ ব্যবহারের ব্যাপকতা দেখা যায়। এছাড়া বৈদ্যুতিক বাল্ব, টিউব লাইটের টিউব, হারিকেনের চিমনি, পার্টিমন দেয়াল কাচ ব্যবহৃত হয়।
কাজের নামের পাশে কাচের উপযোগী ব্যবহার:-
১.দরজা-জানালার পাল্লা: সেফটি গ্লাস, শিট গ্লাস, অয়্যার্ড গ্লাস।
২.পার্টিশন দেয়াল: প্লেট গ্লাস।
৩.স্কাইলাইট জানালা: অয়্যার্ড গ্লাস।
৪.যানবাহনের জানালা: সেফটি গ্লাস, রঙিন গ্লাস।
৫.বোতল, হারিকেনের চিমনি, পানির গ্লাস: সোডালাইম গ্লাস।
৬.রাসায়নিক যন্ত্রপাতি, লেন্স: বোরোসিলিকেট গ্লাস।
৭.শব্দ ও তাপ অন্তরক দেয়াল ও মেঝে: ফাইবার গ্লাস।
৮.শব্দ ও তাপ অন্তরকের কাজ: গ্লাস উল।
৯.আলোকীয় কাজ ও কারুকার্য: লিড গ্লাস।
১০.হিমাগারের কক্ষ: ফোম গ্লাস।
১১.গবেষণাগারে: প্লাস্টিক গ্লাস।
১২.প্রতিফলিত দৃশ্য দেখার জন্য: মিরর (আয়না)।
১৩.গাড়ির ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশের কাজ: পাইরোসিরাম।
১৪.সার্ভে যন্ত্রপাতি: প্রিজম গ্লাস।
১৫.রঙ্গমঞ্চ, উপাসনালয়: স্টেইনড গ্লাস।